বর্তমান সময়ে সম্ভবত ক্যানসার সবচেয়ে আলোচিত ও ভীতিকর রোগ। ক্যানসার নিয়ে মানুষের মধ্যে রয়েছে অনেক অজ্ঞতা ও অসচেতনতা। মানবদেহে বিভিন্ন ধরনের ক্যানসার হতে পারে। সকল ক্যানসারের ভয়াবহতা ও পরিণতি এক নয়। ক্যানসার যদি খুব শুরুতেই শনাক্ত (early diagnosis) করা যায় তাহলে এর চিকিৎসা অনেক সহজ হয়ে যায়। আর এ থেকে মুক্তির সম্ভাবনাও বেড়ে যায় বহু গুনে। ক্যানসার শনাক্ত করার জন্য আমরা বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করি। শনাক্তকরণ প্রক্রিয়ায় প্রচলিত এসব পদ্ধতিগুলোর রয়েছে নানাবিধ সীমাবদ্ধতা। তাই প্রাথমিক পর্যায়ে (early stage) ক্যানসার শনাক্তকরণের সহজ ও অধিক কার্যকরী (more efficient) পদ্ধতি উদ্ভাবনের কাজে নিয়োজিত আছেন গবেষকেরা। বাংলাদেশের সন্তান ড. মো. জসিম উদ্দিন চিকিৎসা বিজ্ঞানের তেমনই একটি বিষয়ে গবেষণা করছেন আমেরিকার ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে (Vanderbilt University)।
ক্যানসারের প্রাথমিক পর্যায়েই আক্রান্ত কোষগুলোতে কক্স-২ (COX-2) নামক একটি এনজাইমকে অতিমাত্রায় উপস্থিত থাকতে দেখা যায়। মো. জসিম উদ্দিন ও তাঁর গবেষণা দল বিশেষ আলোক সংবেদী কিছু রাসায়নিক যৌগ আবিষ্কার করেছেন। যেগুলো নির্দিষ্টভাবে (Selectively) কক্স-২ এনজাইমের সঙ্গে যুক্ত হয়ে শুধুমাত্র ক্যানসার আক্রান্ত কোষগুলোকে শনাক্ত করতে সক্ষম। বিষয়টিকে জোনাকি পোকার সঙ্গে তুলনা করুন। অন্ধকারে যখন জোনাকি পোকারা জ্বলে ওঠে, তখনই এদের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। পেটেন্টেড (Patent No. US 2010 / 0254910) এই রাসায়নিক যৌগগুলোর একটি ফ্লোরকক্সিব এ (Fluorocoxib A) নামে পরিচিত। প্রাণীর দেহে প্রবেশ করানোর পর এটি কক্স-২ এনজাইমের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তীব্রভাবে জ্বলে ওঠে। আক্রান্ত কোষগুলোতে খুব সামান্য পরিমাণে কক্স-২ এনজাইম উপস্থিত থাকলেও সেগুলোকে সহজেই শনাক্ত করা যাচ্ছে। তার এই আবিষ্কার ২০১০ সালে প্রকাশিত হয়েছে একটি আন্তর্জাতিক মেডিকেল জার্নালে (Cancer Research, 2010, 70,3618-3627)। উদ্ভাবনের খবর উঠে আসে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। নানান সম্মানের পাশাপাশি, এই সফলতার স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৩ সালে তিনি ওমিক্স (Omics International) গ্রুপের রিকগনিশন সনদও লাভ করেন। খুব শিগগিরই এই প্রযুক্তিটি মানবদেহে প্রয়োগের আশা করছেন তিনি। যেটি তার দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা। এই যৌগ দিয়ে ত্বক (skin), মূত্রথলি (bladder), অন্ননালি (esophageal) ও কোলন (colon) ক্যানসার খুব প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্তকরণ সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।
মো. জসিম উদ্দিনের জন্ম নোয়াখালীর বাটইয়া গ্রামে। তিনি হাজি মো. হানিফ উদ্দীন ও বেগম সাফিয়া খাতুনের প্রথম সন্তান। তার শৈশব ও বেড়ে ওঠা ঢাকার জিগাতলায়। ঢাকার রাইফেলস পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে। অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন আহমেদের কাছে তাঁর গবেষণার হাতেখড়ি। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষে জসিম উদ্দিন কর্মজীবন শুরু করেন বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির অ্যান্টিবায়োটিক প্ল্যান্টে। পরে ১৯৯৭ সালে জাপান সরকারের মনবুসো (Monbusho) বৃত্তি নিয়ে চলে যান জাপানের শিনসু বিশ্ববিদ্যালয়ে (Shinshu University)। সেখানে ডক্টরাল গবেষণা করেছেন অধ্যাপক আইওয়াও ইয়ামমোটোর (Professor Iwao Yamomoto) সঙ্গে। তারপর আলবার্টা হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের বৃত্তি নিয়ে কানাডার আলবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ে (University of Alberta) পোস্ট ডক্টরাল গবেষণা করেন। অবশেষে ফ্যাকাল্টি হিসেবে গবেষণা শুরু করেন ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগে। বর্তমানে সেখানেই তিনি সহযোগী অধ্যাপক (গবেষণা) হিসেবে কর্মরত আছেন।
বাংলাদেশে গবেষণার অবস্থা তাঁকে ব্যথিত করে। বলেন, বাংলাদেশে অফুরন্ত মেধা ও সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বিজ্ঞানের মৌলিক ও অপরিহার্য বিষয়ে কোনো উন্নতমানের গবেষণা এখনো চোখে পড়ছে না। পিএইচডি ডিগ্রি ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ প্রসঙ্গেও হতাশা প্রকাশ করলেন। বললেন, স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে দেশে উচ্চ শিক্ষিতের হার অনেক কম ছিল। তখন শিক্ষক নিয়োগে পিএইচডি ডিগ্রিধারী প্রার্থী পাওয়া যেত না। কিন্তু এখন পরিস্থিতি অনেক বদলেছে। এখনো সেই নিয়ম ধরে রাখার প্রয়োজনীয়তা নেই বলেই তিনি মনে করেন।
ফ্লোরকক্সিব-এশিক্ষার্থী ও গবেষকেরা যেন দেশেই করতে পারে উন্নতমানের গবেষণা সে জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টার কথা বললেন। প্রবাসে থেকেও বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণা নিয়ে সহযোগিতা করতে তিনি আগ্রহী। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণায় বিনিয়োগের জন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এগিয়ে আসা উচিত বলে তিনি মনে করেন। স্বপ্ন দেখেন, একদিন বাংলাদেশ থেকেই বেরিয়ে আসবে রসায়ন ও চিকিৎসা শাস্ত্রসহ বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী।
প্রতিনিয়তই বাংলাদেশের কথা মনে পড়ে তাঁর। দেশে যোগাযোগ হয় নিয়মিত। সুযোগ পেলেই দেশে যান। এক ছেলে, এক মেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে সংসার। গবেষণা, শিক্ষকতা আর জীবন-সংসারের রসায়ন নিয়ে কেটে গেছে বহু বছর। মানব কল্যাণে তাঁর গবেষণা অবদান রাখবে, সর্বশক্তিমানের কাছে এটুকুই চাওয়া। তাঁর গবেষণা নিয়ে বিস্তারিত জানতে তাঁর ওয়েবসাইট দেখতে পারেন: <https://goo.gl/g68Vja>
*ড. রউফুল আলম, গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া, ফিলাডেলফিয়া, যুক্তরাষ্ট্র। ই-মেইল: redoxrouf@yahoo. com
----------------------------
ক্যানসারের প্রাথমিক পর্যায়েই আক্রান্ত কোষগুলোতে কক্স-২ (COX-2) নামক একটি এনজাইমকে অতিমাত্রায় উপস্থিত থাকতে দেখা যায়। মো. জসিম উদ্দিন ও তাঁর গবেষণা দল বিশেষ আলোক সংবেদী কিছু রাসায়নিক যৌগ আবিষ্কার করেছেন। যেগুলো নির্দিষ্টভাবে (Selectively) কক্স-২ এনজাইমের সঙ্গে যুক্ত হয়ে শুধুমাত্র ক্যানসার আক্রান্ত কোষগুলোকে শনাক্ত করতে সক্ষম। বিষয়টিকে জোনাকি পোকার সঙ্গে তুলনা করুন। অন্ধকারে যখন জোনাকি পোকারা জ্বলে ওঠে, তখনই এদের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। পেটেন্টেড (Patent No. US 2010 / 0254910) এই রাসায়নিক যৌগগুলোর একটি ফ্লোরকক্সিব এ (Fluorocoxib A) নামে পরিচিত। প্রাণীর দেহে প্রবেশ করানোর পর এটি কক্স-২ এনজাইমের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তীব্রভাবে জ্বলে ওঠে। আক্রান্ত কোষগুলোতে খুব সামান্য পরিমাণে কক্স-২ এনজাইম উপস্থিত থাকলেও সেগুলোকে সহজেই শনাক্ত করা যাচ্ছে। তার এই আবিষ্কার ২০১০ সালে প্রকাশিত হয়েছে একটি আন্তর্জাতিক মেডিকেল জার্নালে (Cancer Research, 2010, 70,3618-3627)। উদ্ভাবনের খবর উঠে আসে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। নানান সম্মানের পাশাপাশি, এই সফলতার স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৩ সালে তিনি ওমিক্স (Omics International) গ্রুপের রিকগনিশন সনদও লাভ করেন। খুব শিগগিরই এই প্রযুক্তিটি মানবদেহে প্রয়োগের আশা করছেন তিনি। যেটি তার দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা। এই যৌগ দিয়ে ত্বক (skin), মূত্রথলি (bladder), অন্ননালি (esophageal) ও কোলন (colon) ক্যানসার খুব প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্তকরণ সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।
মো. জসিম উদ্দিনের জন্ম নোয়াখালীর বাটইয়া গ্রামে। তিনি হাজি মো. হানিফ উদ্দীন ও বেগম সাফিয়া খাতুনের প্রথম সন্তান। তার শৈশব ও বেড়ে ওঠা ঢাকার জিগাতলায়। ঢাকার রাইফেলস পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে। অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন আহমেদের কাছে তাঁর গবেষণার হাতেখড়ি। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষে জসিম উদ্দিন কর্মজীবন শুরু করেন বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির অ্যান্টিবায়োটিক প্ল্যান্টে। পরে ১৯৯৭ সালে জাপান সরকারের মনবুসো (Monbusho) বৃত্তি নিয়ে চলে যান জাপানের শিনসু বিশ্ববিদ্যালয়ে (Shinshu University)। সেখানে ডক্টরাল গবেষণা করেছেন অধ্যাপক আইওয়াও ইয়ামমোটোর (Professor Iwao Yamomoto) সঙ্গে। তারপর আলবার্টা হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের বৃত্তি নিয়ে কানাডার আলবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ে (University of Alberta) পোস্ট ডক্টরাল গবেষণা করেন। অবশেষে ফ্যাকাল্টি হিসেবে গবেষণা শুরু করেন ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগে। বর্তমানে সেখানেই তিনি সহযোগী অধ্যাপক (গবেষণা) হিসেবে কর্মরত আছেন।
বাংলাদেশে গবেষণার অবস্থা তাঁকে ব্যথিত করে। বলেন, বাংলাদেশে অফুরন্ত মেধা ও সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বিজ্ঞানের মৌলিক ও অপরিহার্য বিষয়ে কোনো উন্নতমানের গবেষণা এখনো চোখে পড়ছে না। পিএইচডি ডিগ্রি ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ প্রসঙ্গেও হতাশা প্রকাশ করলেন। বললেন, স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে দেশে উচ্চ শিক্ষিতের হার অনেক কম ছিল। তখন শিক্ষক নিয়োগে পিএইচডি ডিগ্রিধারী প্রার্থী পাওয়া যেত না। কিন্তু এখন পরিস্থিতি অনেক বদলেছে। এখনো সেই নিয়ম ধরে রাখার প্রয়োজনীয়তা নেই বলেই তিনি মনে করেন।
ফ্লোরকক্সিব-এশিক্ষার্থী ও গবেষকেরা যেন দেশেই করতে পারে উন্নতমানের গবেষণা সে জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টার কথা বললেন। প্রবাসে থেকেও বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণা নিয়ে সহযোগিতা করতে তিনি আগ্রহী। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণায় বিনিয়োগের জন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এগিয়ে আসা উচিত বলে তিনি মনে করেন। স্বপ্ন দেখেন, একদিন বাংলাদেশ থেকেই বেরিয়ে আসবে রসায়ন ও চিকিৎসা শাস্ত্রসহ বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী।
প্রতিনিয়তই বাংলাদেশের কথা মনে পড়ে তাঁর। দেশে যোগাযোগ হয় নিয়মিত। সুযোগ পেলেই দেশে যান। এক ছেলে, এক মেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে সংসার। গবেষণা, শিক্ষকতা আর জীবন-সংসারের রসায়ন নিয়ে কেটে গেছে বহু বছর। মানব কল্যাণে তাঁর গবেষণা অবদান রাখবে, সর্বশক্তিমানের কাছে এটুকুই চাওয়া। তাঁর গবেষণা নিয়ে বিস্তারিত জানতে তাঁর ওয়েবসাইট দেখতে পারেন: <https://goo.gl/g68Vja>
*ড. রউফুল আলম, গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া, ফিলাডেলফিয়া, যুক্তরাষ্ট্র। ই-মেইল: redoxrouf@yahoo. com
----------------------------