কয়েক বছর আগে পত্রিকায় দেখলাম ডি.সি. পোস্টের জন্য বাছাই পরীক্ষায় ইংরেজী চিঠি ড্রাফট করতে গিয়ে ৩২ জনের মধ্যে মাত্র দুজন কাজটি সঠিকভাবে করতে পেরেছিলেন। শতকরা হিসেবে ৬% মাত্র।
এখন চিন্তা করুন আমাদের সচিবালয়ের কি করুন দশা। এটা হয়তো আসল চিত্র না, তারপরও আসল চিত্রটা কতটুকু আর উন্নতর হবে?
প্রশাসনিক ক্যাডারের এ সব কর্মকর্তারা অন্য সব ক্যাডারের উপর ছড়ি ঘুরাবেন কোন যুক্তিতে? ফেলটুরা সচিবালয়ে প্রবেশাধিকার পেলে পেশাজীবিদের জন্য সচিবালয়ের পথ বন্ধ থাকবে কেন?
আমরা তো মনে করি সচিবালয়ে যোগদানের বিষয়টা উন্মুক্ত ও নিরপেক্ষ প্রতিযোগীতার মাধ্যমে হওয়া উচিত।দেশ গড়ার সুতিকাগারের দায়িত্বটা মেধাবীদেরই হাতে থাকা উচিত, তা যে প্রফেশন থেকেই আসুন না কেন?
প্রশাসনিক ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন তারপর নানান স্তর পেরিয়ে সচিবালয়ে প্রবেশ করেন। এ গতিপথে এমন কি গায়েবী জ্ঞান অর্জন করে ফেলেন যে, তিনি একাধারে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রকৌশল, কৃষি, পানি সম্পদ ইত্যাদি টেকনিকেল মন্ত্রনালয় সমুহের প্রায়োগিক ও অবকাঠামোগত বিশেষজ্ঞ হয়ে তার ৮/১০ ব্যাচ সিনিয়র পেশাজীবিদের উপর ছড়ি ঘুরানোর ক্ষমতালব্ব্দ হন। এটা নিতান্তই হাস্যকর ও ডগমেটিক একটা ব্যাপার নয় কি?
পেশাজীবি ক্যাডাররা প্রশাসনিক ক্যাডারের জুনিয়র ব্যাচের একজনকে কেন স্যার সম্বোধন করবেন?
এর জবাব কি রাষ্ট্রের কাছে আছে? এ সব প্রশাসনিক এনারকি গুলোর সংষ্কার অতীব জরুরী।
সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার স্বীকার করে বলেছেন, ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী পদে চাকরির জন্য পৃথিবীর কোথাও এক্সট্রাঅডিনারি মেধাবীরা ভীড় জমান না। ট্যালেনটেড যারা তারা আবিষ্কার করেন নতুন কিছু সৃষ্টি করেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারির মেধাবীরা সেসব প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে জীবন পার করে দেন’।
স্বাধীনতার পর দেশে জনবল সংকট ছিল তখন বিশেষ পরিস্থিতিতে তা গ্রহনযোগ্য ছিল, এখন সে প্রেক্ষাপট বদলে গেছে, ডিজিটাল যুগেও সে প্রথা কেন রয়ে যাবে?
সার্ক দেশ সমুহের মধ্যে কোথায় এ সিস্টেম আছে?
আমরা বলছি না, সচিবালয়ে মেধাবীরা নেই, দেশের নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পরীক্ষায় ভাল রেজাল্টধারী অনেকেই সেখানে আছেন।কিন্তু তাদের অাধিপত্য কি খুব বেশী আছে। আমরা ঢালাওভাবে একটি বিশেষ ক্যাডারের অনৈতিক আধিপত্যের অবসান ঘটিয়ে দেশের নীতি নির্ধারনী ফোরামে সকল মেধাবীদের সুযোগ দেয়ার কথা বলছি।স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর প্রশাসনের মূল কেন্দ্রে ২য় বা তৃতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তাদের অাধিপত্য কেন থাকবে?
চিকিৎসকদের অনেক সমালোচনা সত্বেও তাদের অনেক অর্জন আছে দেশ ও জাতির জন্য।আমলাদের অর্জনটা কি? বিশ্বে বাংলাদেশ সচিবালয়ের গ্রেডিং কত?
দুর্নীতির চ্যাম্পিয়নশীপের দায়ভার কেবল রাজনৈতিক নেতাদের মাথায় থাকবে কেন? দুর্নীতির অভিযোগের সর্বাগ্রে দায় দায়িত্ব নেয়ার কথা ‘পলিসি মেকার’ আমলাদের। কারন রাজনৈতিক দল আসা-যাওয়ার মধ্যেই থাকে, সচিবালয় স্থায়ী। কিন্তু বরাবরই এ সব ব্যর্থতা সুচতুর সচিবরা রাজনৈতিক দলের ঘাড়ে চালান করে পার পেয়ে যান।
সাবেক সচিব আকবর আলী খানের ভাষায় আমাদের আমলাতন্ত্র বৃটিশদের রেখে যাওয়া এক প্রশাসনিক isomorphism. বাইরে ফিটফাট ভেতরে বেশ রুগ্ন ও দুর্বল। তাদের কাজ কর্ম অনেকটা প্রাণীদেহের molecular mimacry টাইপ। বিষহীন সর্প যেমন গায়ের রঙ পরিবর্তন করে শিকারীকে ভয় দেখায়।
রাজনৈতিক দল গুলো যতই প্রতিশ্রুতি দিক না কেন সচিবালয়ের সংষ্কার ও গনমুখী প্রশাসন ছাড়া কর্মসূচীর সুফল পাবে না জনগন। এ সংষ্কার অনেক আগেই হওয়া উচিত ছিল। কোঠারী স্বার্থবাদীদের উৎপাটন না করে সৎ ও দক্ষ প্রশাসন গড়া সম্ভব না।
অযোগ্য ও অসৎ কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে প্রতিযোগীতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে প্রশাসনে সব পেশার মেধাবীদের প্রবেশের সুযোগ দেয়া প্রয়োজন। এটা সময়ের দাবী।
একটা কথা প্রচার সুকৌশলে করা হয় যে, ডাক্তাররা প্রশাসন বুঝেন না।মনে হয় এরা দেশের ‘অটিস্টিক শিশু’।
কিন্তু প্রশ্ন হলো ডাক্তারদের কি ইউ.এন.ও বা ডি.সি ‘র সমান ক্ষমতা দেয়া হয়েছে? হাত পা বেধে কি প্রশাসক হওয়া যায়? এ ব্যবস্থায় একজন চিকিৎসক সমন্বয়কারীর ভূমিকায় রাখতে পারে মাত্র। যা চিকিৎসকরা যোগ্যতার সাথেই করছে।
সচিবালয়ের দার উন্মুক্ত করুন দেশের শয়ে শয়ে মেধাবী ডাক্তার তৈরী আছে। তখন দেখা যাবে চিকিৎসকরা প্রশাসন বুঝেন কিনা। প্রশাসনিক নির্বাহী হওয়ার হাতছানি ছাড়া একজন চিকিৎসক নিজেকে সেভাবে গড়তে যাবেন কেন।
সচিবালয় যদি উন্মুক্ত না করতে পারেন তাহলে চিকিৎসকদের এ মুহুর্তের দাবী স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়কে আলাদা করে তার জন্য আলাদা বেতন কাঠামো ও বিধি প্রণয়নের সুযোগ দেয়া হোক।
বিশ্বের অনেক দেশেই এটা করে সুফল পাওয়া গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ বিশ্বের অনেকগুলো দেশেই চিকিৎসকরাই উচ্চ বেতনধারী পেশাজীবির মর্যাদাপ্রাপ্ত। বেসরকারী মেডিকেলের কিছু অব্যবস্থাপনা সত্বেও এখনও পর্যন্ত গড়পড়তা হিসেবে দেশের বেশীর ভাগ মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীর সমাবেশ এ পেশাতেই।
পোষ্ট না থাকা সত্বেও শয়ে শয়ে অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব পদোন্নতি নিয়ে জনগনের টাকার শ্রাদ্ধ করতে পারেন আর স্বাস্থ্য ক্যাডারের একজন মেধাবী চিকিৎসক সারা জীবন গ্রামে থেকে মেডিকেল অফিসার হিসেবে অবসরে যাবেন এই অসম কৌতুককর অবস্থার কখন অবসান ঘটবে?
কেন চিকিৎসকরা পরিশ্রমের মর্যাদা পাবেন না? তাদের পোস্টিং দেবেন কিন্তু অফিস দেবেন না, অফিস থাকলে ও আসবাব নেই, আবাসিক ব্যবস্থা নেই, গাড়ী নেই, প্রমোশন নেই, ২৪ ঘন্টা শ্রম ঘন্টার বেতন নেই……. নেই তো নেই তা নিয়ে চিকিৎসকদের খেদোক্তি নেই। তারপরও যদি থাকত যথার্থ মর্যাদা আর নিরাপদ কাজের পরিবেশ।
এতটুকু প্রত্যাশা দেশের মেধাবী সন্তান হিসেবে নিশ্চয় বেশী না। কাজের ধরন ও পরিবেশ বিবেচনায় চিকিৎসকরা অন্য পেশার প্রতিদ্বন্ধী অবশ্যই না, এবং সে রকম তারা মনেও করে না।তারপরও তারা বৈষম্যের শিকার কেন হবে? রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় কেন অবহেলিত থাকবে।
এ সব সমস্যা নিরসনে পেশাজীবিদের মোর্চাও তেমন সক্রিয় না।আমাদের পেশাজীবি মোর্চাগুলো পেশার চেয়েও রাজনৈতিক সংযোগ রক্ষায় অধিক মনোযোগী বিধায় দাবী আদায়ে আকাংখিত ফলাফল পান না।
এখন সময় এসেছে ঐক্যবদ্ধভাবে কার্যকর ও যৌক্তিক আন্দোলন গড়ে তোলার।#
লেখা - ডাঃ রেজাউল করিম
------------------------------------------